মানব জীবনের এক শাশ্বত-সুন্দর অনুভূতির নাম প্রেম। নিত্যদিনের বেঁচে থাকার সংগ্রাম, রুদ্ধশ্বাস ছুটে চলার ক্লান্তি সব দূর করে দেয় হৃদয়ের সূক্ষ্মতম এই অনুভূতি।
তথ্য-প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষের এই যুগে অনেককিছুর মতো হয়তো বদলে গেছে প্রেমের প্রকাশ মাধ্যম, ধরন, গতি-প্রকৃতি। কিন্তু বদলায়নি প্রেমের অনুভব-আবেগ। বিপরীত সত্তাকে মহার্ঘ্য মেনে আপন সত্তাকে সমর্পণের আকুতি রয়ে গেছে একইরকম।
সাহিত্য যেহেতু জীবনেরই প্রতিফলন, এক অনিবার্য উপাদান হিসেবে সাহিত্যে প্রেম ধরা দিয়েছে বারংবার। বাংলা সাহিত্যেও ঘটেনি ব্যত্যয়। সেই সূচনালগ্ন থেকেই প্রেমের প্রকাশ ঘটেছে নানা রূপে, নানা ব্যঞ্জনায়।
বাংলা ভাষায় প্রেমকে উপজীব্য করে রচিত হয়েছে অসংখ্য কালজয়ী গ্রন্থ। তার মধ্য থেকে দু-চারটি রচনাকে সেরার তকমা দেয়া দুষ্কর। তবু হৃদয়ের এই চিরন্তন অনুভূতিকে নতুন করে আবিস্কার করার মতো মুগ্ধতা জাগানিয়া কিছু উপন্যাস নিয়েই এ বিশেষ আয়োজন।
রবীন্দ্রনাথের মতো করে মানব মনের দুর্গমতম জায়গা আর কে ছুঁতে পেরেছেন? মানব মনের গভীরতম প্রেম আর চিরায়ত মানসিক দ্বন্দ্ব নিয়েই তিনি লিখেছেন বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রেমের আখ্যান ‘শেষের কবিতা’। অমিত-লাবণ্যর প্রেম ও বিরহ দর্শন আর অপরূপ ভাষাশৈলী উপন্যাসটিকে দিয়েছে ধ্রুপদী সাহিত্যের মর্যাদা।
সম্ভ্রান্ত পরিবারের তুর্কী বংশোদ্ভূত আফগান কন্যা শবনম এবং বাংলাদেশী যুবক মজনূনের প্রেম আর বিচ্ছেদকে ঘিরেই আবর্তিত উপন্যাসের কাহিনি। যে উপন্যাস সম্পর্কে খ্যাতিমান শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেছিলেন, “বাঙালি তরুণ-তরুণীদের প্রেমে পড়ার পূর্বে অবশ্যই সৈয়দ মুজতবা আলীর শবনম উপন্যাসটি পড়ে নেয়া উচিত। এমন শিক্ষণীয় প্রেমের উপন্যাস বিশ্বসাহিত্যে আর একটিও নেই।”
বাঙালির চিরন্তন আবেগের কালজয়ী উপাখ্যান ‘দেবদাস’। আর্থ-সামাজিক প্রতিবন্ধকতায় দেবদাস-পার্বতীর বিচ্ছেদ, চন্দ্রমুখীর একমুখী অনুভব আর অতিরিক্ত মদ্যপানে আসক্তির কারনে অসুস্থ হয়ে দেবদাসের করুণ মৃত্যু নিয়ে রচিত এ আখ্যানটি জনপ্রিয়তার বিচারে দখল করে আছে শ্রেষ্ঠত্বের আসন।
বাংলা ভাষায় রচিত উল্লেখযোগ্য এক প্রণয়ধর্মী আখ্যান নিমাই ভট্টাচার্যের ‘মেম সাহেব’ । নায়ক বাচ্চুর মনে মেমসাহেবের প্রতি নিষ্ঠা, ভালোবাসা আর তাকে হারিয়ে ফেলার তীব্র যন্ত্রণা প্রকাশিত হয়েছে দোলা বৌদিকে লেখা চিঠির মধ্য দিয়ে।
বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক রোমান্টিক উপন্যাস ‘কপালকুণ্ডলা’। সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত উপন্যাসটি গড়ে উঠেছে মানব প্রেম, সামাজিকতা, ইতিহাস ও অতিপ্রাকৃত উপাদানের মিশেলে। নবকুমার আর কপালকুণ্ডলার মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত,পদ্মাবতীর জীবনকথা, কাপালিকের চক্রান্ত সব মিলিয়েই বাংলা সাহিত্যের অনন্য এক সম্পদ হয়ে আছে উপন্যাসটি।
আর্থ-সামাজিক নানা বিষয়কে কেন্দ্র করে মানিক বন্দোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ এ উপন্যাসের কাহিনির বিস্তার ঘটলেও শেষ পর্যন্ত শশী-কুসুমের প্রণয়াখ্যানই মুখ্য হয়ে ধরা দেয় পাঠকহৃদয়ে। একে-অপরের প্রতি প্রবল ভালোবাসা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত তারা যেন পুুতুলমাত্র। তাদের পরিচালনা করার সুতোটি যেন অন্য কারো হাতে।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের এক অনন্য উপন্যাস ‘কবি’। ডাকাত বংশের ছেলে হয়েও কবিয়াল হয় নিতাই। বিবাহিত ঠাকুরঝির সাথে গড়ে ওঠে তার প্রণয়ের সম্পর্ক। অতঃপর সামাজিক পরিস্থিতির কারণে ঘটে বিচ্ছেদ। গ্রাম ছেড়ে গিয়ে অবশেষে বসন্তর মাঝে সে খুঁজে নেয় প্রেমের অপরূপ মূর্তি। কিন্তু পৃথক বাস্তবতায় দুজনেরই মৃত্যু নিতাইয়ের গহনে জন্ম নেয়া হাহাকার ধ্বনি- “এই খেদ আমার মনে-
ভালোবেসে মিটল না এ সাধ, কুলাল না এ জীবনে !
হায়- জীবন এত ছোট কেনে?” ভারাক্রান্ত করে প্রতিটি পাঠক হৃদয়।
তিথিডোর
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সামাজিক প্রেক্ষাপটে লেখা মুগ্ধতা জাগানিয়া এক উপন্যাস বুদ্ধদেব বসুর ‘তিথিডোর’। স্বাতী এবং সত্যেনের নিঃসঙ্গতা, একে অপরের প্রতি ভালোবাসা, মধ্যবিত্ত জীবনের সুখ দুঃখ, দ্বন্দ্ব, নিঃসঙ্গতার এক অসামান্য মেলবন্ধন ঘটেছে এ উপন্যাসে।
কালবেলা
খ্যাতিমান কথাসাহিত্যিক সমরেশ মজুমদারের বিখ্যাত ট্রিলজি ‘উত্তরাধিকার’, ‘কালবেলা’ ও ‘কালপুরুষ’- এর দ্বিতীয় অধ্যায় ‘কালবেলা’। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে রচিত হলেও সব ছাপিয়ে পাঠকহৃদয়ে দাগ কেটে যায় উপন্যাসের প্রধান চরিত্র অনিমেষ-মাধবীলতার প্রেম।
ন হন্যতে
মৈত্রেয়ী দেবী রচিত ‘ন হন্যতে’ উপন্যাসটিকে অনন্য এক জীবনীগ্রন্থ কিংবা লেখকের প্রাক্তন প্রেমিক মির্চা এলিয়াদের লেখা ‘লা নুই বেঙ্গলি’র প্রত্যুত্তরও বলা যেতে পারে। গ্রন্থটিতে মির্চা এলিয়াদের প্রতি লেখকের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা আর বিচ্ছেদের নান্দনিক প্রকাশে নিছক স্মৃতিচারণামূলক গ্রন্থটিই হয়ে উঠেছে বাংলা সাহিত্যের অমূল্য এক সম্পদ।
প্রেমের গভীর ও বিচিত্র রূপ নিয়ে বুদ্ধদেব গুহর অসামান্য এক উপন্যাস ‘একটু উষ্ণতার জন্য’। সুকুমার নামের এক লেখকের জীবনের একদিকে ভালোবেসে বিয়ে-করা স্ত্রী’র দূরে সরে যাওয়া, ছুটি নামের এক ভক্তের প্রবেশে হিম-হয়ে যাওয়া হৃদয়ে তাপ সঞ্চারণ অন্যদিকে অদ্ভূত এক টানাপোড়েন, সব মিলিয়েই হৃদয়ছুঁয়ে যাওয়া এক উপন্যাস।
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের অন্যতম প্রেমের উপন্যাস ‘কাগজের বউ’। উচ্চ শিক্ষিত, মেধাবি যুবক উপলকে ভাগ্যের পরিহাসে ডাকাতি, বাস কন্ট্রাক্টরির মতো বহুবিধ পেশা অবলম্বন করতে হয়। জীবনের বিভিন্ন পর্যায় পেরিয়ে কীভাবে সে পৌছায় তার আকাঙ্ক্ষিত প্রেমের কাছে তারই বর্ণনা রয়েছে গ্রন্থটিতে।
জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের এক অসামান্য প্রেমের আখ্যান ‘মেঘ বলেছে যাব যাব’। মধ্যবিত্ত জীবনের ভালোবাসা, সম্পর্কের বহুমাত্রিকতা, টানাপোড়েন প্রভৃতির পাশাপাশি হাসান ও তিতলির গভীর প্রণয় আর বিচ্ছেদ হাহাকার অসামান্য নৈপুণ্যে ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক।
এর বাইরেও বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের দুর্গেশনন্দিনী, চন্দ্রশেখর; রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঘরে-বাইরে, নৌকাডুবি; শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের শ্রীকান্ত, দত্তা, পরিণীতা; শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঝিন্দের বন্দী; বুদ্ধদেব বসুর রাতভরে বৃষ্টি; বুদ্ধদেব গুহ’র সবিনয় নিবেদন; জহির রায়হানের হাজার বছর ধরে, শেষ বিকেলের মেয়ে; সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সুদূর ঝর্নার জলে, ছবির দেশে কবিতার দেশেসহ বাংলা সাহিত্যের অসংখ্য উপন্যাসে প্রেমের বহুমাত্রিকতা চিত্রিত হয়েছে নিপুণ নান্দনিকতায়।