boi-mela

অমর একুশে বইমেলার শুরুটা হলো যেভাবে

একদিকে দীর্ঘ লাইন টিএসসি ছাড়িয়ে। অন্য দিকে অজস্র মানুষ ব্যস্ত দোয়েল চত্বর অতিক্রমণে। অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রবেশের স্বাভাবিক দৃশ্য এমনই। 

এই মেলা এখন বাঙালির প্রাণের মেলা। রাজধানী শহরে বসবাস অথচ একুশে বইমেলায় পদচ্ছাপ পড়েনি এমন মানুষের সংখ্যা সামান্যই। কেবল বইমেলাকে উপলক্ষ করেই দেশের নানা প্রান্ত থেকে সমাগম ঘটে বইপ্রেমীদের। এ আয়োজন পরিণত হয়েছে লেখক, পাঠক ও প্রকাশনাশিল্পে নিয়োজিতদের এক ভেদহীন আসরে। বইমেলায় মেলে আনকোরা বইসমূহ। সাক্ষাৎ মেলে বইয়ের মানুষের। মানুষ টানার অনবদ্য স্বকীয়তায় এ আয়োজন তাই বিশেষ প্রভাব রাখে জনপদে।

১৯৫২ সালে মাতৃভাষার দাবিতে বাঙালি হারিয়েছিল ভাই। সেই ২১ ফেব্রুয়ারি এখন ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হয়ে সমাদৃত সারা বিশ্বে। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বেদনা। একই সঙ্গে এই ৮ ফাল্গুন এক অপ্রতিরোধ্য শক্তির উৎস। সকল অন্যায়, জুলুমের বিরূদ্ধে মাথা নত না করার শিক্ষা দেয় এর ইতিহাস। তবে বইমেলার যাত্রা কিন্তু ৫২ সালে নয়। অমর একুশে গ্রন্থমেলার শুরু স্বাধীন বাংলাদেশে।

সালটা ১৯৭২। সদ্য স্বাধীন দেশে ৮ ফেব্রুয়ারি শ্রী চিত্তরঞ্জন সাহা বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউসের সামনের বটতলায় এক টুকরো চটের কাপড়ের ওপর কলকাতা থেকে আনা ৩২টি বই নিয়ে শুরু করেন বিক্রি। সেখানেই বইমেলার শেকড় বিস্তৃত হতে হতে এখন তা মহিরুহ। প্রথম সেই বইগুলি ছিল মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে থাকা বাংলাদেশি শরণার্থী লেখকদের লেখা। বইগুলি প্রকাশিত হয়েছিল চিত্তরঞ্জন সাহা প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ (বর্তমানে মুক্তধারা প্রকাশনী) থেকে। 

১৯৭৩ সালে বাংলা একাডেমি ফেব্রুয়ারির ১৫- ২১ তারিখ পর্যন্ত বিশেষ হ্রাসকৃত মূল্যে একাডেমি প্রকাশিত বই বিক্রির ব্যবস্থা করে। পাশাপাশি মুক্তধারা, স্ট্যান্ডার্ড পাবলিশার্স এবং এদের দেখাদেখি আরও বেশ কিছু প্রকাশনা সংস্থা একাডেমির মাঠে শুরু করে নিজেদের বই বিক্রি।

১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমি ১৪ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজন করে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐ সম্মেলনের উদ্বোধন করেন। এ উপলক্ষে বাংলা একাডেমি তার নিজস্ব প্রকাশিত বই ও ম্যুরাল প্রদর্শনীর আয়োজন করে। প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রফেসর আবু মহাম্মেদ হবীবুল্লাহ।

ফেব্রুয়ারির এ আয়োজনে গণজমায়েত দেখে ঢাকার বিভিন্ন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান অংশ নিতে থাকে। একাডেমির পূর্বদিকের দেয়াল বরাবর নিজেদের পছন্দ মতো জায়গায় যে যার মতো স্টল নির্মাণ করে বই বিক্রির ব্যবস্থা করে। এভাবেই ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে পরিসর, সমাগম। সে সময়টায় এ আয়োজনে বাংলা একাডেমির কোনো ভূমিকা ছিল না; শুধু মাঠের জায়গাটুকু দেয়া ছাড়া।

১৯৭৫ সালে সক্রিয় হয় বাংলা একাডেমি। মাঠের কিছু জায়গা চুনের দাগ দিয়ে প্রকাশকদের জন্য নির্দিষ্ট করে দেয়। প্রকাশকরা যে যার মতো স্টল তৈরি করে বই বিক্রির ব্যবস্থা করে। এ অবস্থা চলতে থাকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত। তখনও এ আয়োজনের কোনো স্বীকৃতি ছিল না। ছিল না কোনো নাম। সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে উল্লেখ থাকত না বই নিয়ে এ সম্মিলনের। এমনকি বাংলা একাডেমির অনুষ্ঠানসূচিতেও এ কার্যক্রমের কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না।

১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক লেখক ও কবি আশরাফ সিদ্দিকী বাংলা একাডেমিকে মেলার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত করেন। ১৯৭৯ সালে মেলার আদল যায় বদলে। ফেব্রুয়ারির এ আয়োজনের সঙ্গে যুক্ত হয় বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি। এই সংস্থাটিরও প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন চিত্তরঞ্জন সাহা। সেই সময় ‘একুশে গ্রন্থমেলা’ শিরোনামে এই মেলা অনুষ্ঠিত হতো ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।

১৯৮১ সালে এই মেলার মেয়াদ কমিয়ে ২১ দিনের পরিবর্তে করা হয় ১৪ দিন। কিন্তু প্র্রকাশকদের দাবির মুখে পরের বছরই মেলার মেয়াদ আবার বাড়িয়ে করা হয় ২১ দিন। তখন থেকে মেলার উদ্যোক্তা হয়ে ওঠে বাংলা একাডেমি। সহযোগিতায় ছিল জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র এবং বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি।

১৯৮৩ সালে মেলার সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রকে বাদ দেয়া হয়। ১৯৮৪ সাল থেকে এই মেলার নতুন নামকরণ করা হয় ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’। তখন থেকেই মেলার সময়সীমা করা হয় পুরো ফেব্রুয়ারি মাস। প্রকাশকদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় বাড়ানো হয় মেলার পরিসর। সেই ৩২টি বই বিক্রির আয়োজন এখন বিপুল আয়তনের মেলা।

মেলার পরিসর এখন বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গন ছাড়িয়ে পাশের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পর্যন্ত বিস্তৃত। বিপুল কলেবরে আয়োজিত মেলার মঞ্চে প্রতিদিন অনুষ্ঠিত হয় নানা সাংস্কৃতিক আয়োজন। মেলা শেষে সেরা প্রকাশক, সবচেয়ে দর্শনীয় স্টল এমন বহু ক্যাটাগরিতে পুরস্কার প্রদান করে বাংলা একাডেমি। বাংলাদেশ সৃজনশীল পুস্তক প্রকাশনা সমিতির অংশগ্রহণ মেলাকে দিয়েছে ভিন্ন এক মাত্রা।

শুধু মননশীলতার বিকাশের দিক দিয়েই নয়, দেশের অর্থনীতিতেও এই মেলার প্রভাব অনস্বীকার্য। এ আয়োজনে বিক্রি হয় কোটি কোটি টাকার বই। 

সব মিলিয়েই বর্তমানে অমর একুশে গ্রন্থমেলা পরিণত হয়েছে বাঙালির অস্তিত্বের অংশে। সবার অপেক্ষা চলে শীত শেষে ফাল্গুন আর ফেব্রুয়ারির জন্য। এই বইকেন্দ্রিক মিলন মেলার জন্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *