সৃষ্টি বৈচিত্র্যে বিংশ শতাব্দীর বিস্ময়কর এক সাহিত্য প্রতিভা কাজী নজরুল ইসলাম। বাংলা সাহিত্যের প্রায় সবগুলি শাখাতেই পড়েছে যাঁর নান্দনিক ছাপ। এত বৈচিত্র্যময় শাখায় এমন সফল ও স্বচ্ছন্দ বিচরণ খুব কম সাহিত্যিকের ক্ষেত্রেই দেখা যায়।
ব্যক্তিজীবনের বর্ণময়তাই হয়তো জুগিয়েছে তাঁর বহুমাত্রিক সাহিত্য রচনার রসদ। দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেয়া নজরুল একসময় কাজ করেছেন রুটির দোকানে, হয়েছেন মুয়াজ্জিন, গান গেয়েছেন লেটোগানের দলে। চাপিয়েছেন সৈনিকের পোশাক। পরাধীনতার অন্ধকারে পড়ে থাকা জাতিকে আলোয় দীপ্তিময় করে তুলতে চষে বেড়িয়েছেন সাহিত্য এবং রাজনীতির মাঠ। মন-প্রাণ উজাড় করে তিনি গেয়েছেন তারুণ্যের জয়গান। নানা অন্যায়-অসাম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হয়েছেন লেখনীর মাধ্যমে।
তাঁর এই অসাম্প্রদায়িক, প্রতিবাদী চেতনাই তাঁকে শত্রুরূপে দাঁড় করিয়েছিল তৎকালীন শাসক, প্রকারান্তরে শোষক শ্রেণির কাছে। এমনকি করতে হয়েছিল কারাভোগও। এমন প্রতিবাদী, বিপ্লবী চেতনায় উদ্দীপ্ত নজরুলের জীবনে সমান্তরালেই এসেছে প্রেম, এসেছে বিচ্ছেদ-প্রত্যাখ্যান। জীবনের পরতে পরতে ঘটে যাওয়া এ সমস্তকিছুরই প্রকাশ ঘটেছে তাঁর বিভিন্ন লেখায়।
কাজী নজরুল ইসলাম মাত্র ২৪ টি বছর যাপন করেছেন সৃষ্টিমুখর জীবন। ১৯৪২ সালে মাত্র ৪৩ বছর বয়সেই বাকশূন্য, বোধশূণ্য হয়ে যান তিনি। মূলত তার সৃষ্টিকর্মের কাল ছিল ১৯১৯ থেকে ১৯৪২ সালের মধ্যে। নাতিদীর্ঘ এই সৃষ্টিশীল জীবনেই সাহিত্য ও সংগীতের প্রায় সর্বাঞ্চলে পড়েছে তার দৃপ্ত পদচারণা। স্বীয় প্রতিভার বহুমাত্রিক স্পর্শে বাংলা সাহিত্য-সংগীতভুবনকে করেছেন ঋদ্ধ, সমৃদ্ধ।
তিনি তাঁর অজস্র সৃষ্টির মধ্য দিয়ে গেয়েছেন নিপীড়িত মানবের জয়গান, নিপুণ হাতে ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁদের আনন্দ- বেদনা, সুখ-দুঃখ, নির্যাতন-নিপীড়নের চিত্র। অবিভক্ত ভারতবর্ষের ধর্মীয়, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক তথা সামগ্রিক মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যে কেবল লেখনীই নয় বরং উৎসর্গ করেন সমগ্র জীবনকেই। তাঁর এই বৈচিত্র্যময় সৃষ্টিতে আজও আবিষ্ট হয়ে আছেন সাহিত্যরসিক থেকে সাধারণ পাঠকও।
সাহিত্যজগতের বিরল এই প্রতিভা কবি হিসেবে সমধিক পরিচিত হলেও গদ্যসাহিত্যেও তাঁর বিচরণ বিস্ময় জাগানিয়া। গান, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, অভিভাষণ এমনকি তাঁর লেখা চিঠিপত্রগুলিও হয়ে আছে বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। শুধু সাহিত্যজগতেই নয় তাঁর পদচারণা ঘটেছে চলচ্চিত্রজগতেও। চলচ্চিত্র পরিচালনার পাশাপাশি করেছেন সঙ্গীত পরিচালনা, অভিনয়। এছাড়াও পালন করেছেন নবযুগ, অর্থ সাপ্তাহিক, ধুমকেতু, লাঙল ইত্যাদি পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব।
নজরুলের সৃষ্টিশীল পথে চলার শুরু মূলত ছোটগল্প রচনার মধ্য দিয়ে। সৈনিক নজরুল করাচি থেকে ছোটগল্প লিখে পাঠাতেন কলকাতার সাহিত্য পত্রিকায়। সমানতালে চলতে থাকে তাঁর কাব্য রচনাও। নজরুলের সাহিত্যযাত্রার নানা পর্যায়ের ধারনা পাওয়া যায় তার লেখা প্রবন্ধ ‘আমার সুন্দর’- এর কয়েকটি লাইনে। সেখানে তিনি লিখেন,‘আমার সুন্দর প্রথম এলেন ছোটগল্প হয়ে, তারপর এলেন কবিতা হয়ে। তারপর এলেন গান, সুর, ছন্দ ও ভাব হয়ে। উপন্যাস, নাটক, লেখা (গদ্য) হয়েও মাঝে মাঝে এসেছিলেন।’
তাঁর নামের শুরুতে কবি বিশেষণটি সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হলেও সংগীতভুবনেই তাঁর উপস্থিতি সবচেয়ে উজ্জ্বল। তিনি নিজেও ১৯৩৮ সালে ‘কৃষক’ পত্রিকার অফিসে জন-সাহিত্য সংসদের উদ্বোধনে সভাপতির ভাষণে বলেছিলেন, ‘কাব্যে ও সাহিত্যে আমি কি দিয়েছি, জানি না। আমার আবেগে যা এসেছিল, তাই আমি সহজভাবে বলেছি, আমি যা অনুভব করেছি, তাই আমি বলেছি। ওতে আমার কৃত্রিমতা ছিল না। কিন্তু সংগীতে যা দিয়েছি, সে সম্বন্ধে আজ কোনো আলোচনা না হলেও ভবিষ্যতে যখন আলোচনা হবে, ইতিহাস লেখা হবে, তখন আমার কথা সবাই স্মরণ করবেন, এ বিশ্বাস আমার আছে। সাহিত্যে দান আমার কতটুকু তা আমার জানা নেই। তবে এইটুকু মনে আছে সংগীতে আমি কিছু দিতে পেরেছি।’
গীতিকার হিসেবে তিনি লিখেছেন সাড়ে চারহাজারেরও বেশি গান যা বাংলা সঙ্গীতের জগতে বিরলতম এক ঘটনা। বহু গানে দিয়েছেন সুর, ধারণ করেছেন নিজ কণ্ঠে। করেছেন সংগীত পরিচালনাও। কেবল সংখ্যার বিচারেই নয় বিষয়-বৈচিত্র্য, নান্দনিকতা ও উৎকর্ষের ক্ষেত্রে নতুন দ্যোতনা ও অশ্রুতপূর্ব মাত্রা যোগ করেছেন তিনি। দ্রোহ শব্দটি যাঁর সমার্থক হয়ে উঠেছিল, সঙ্গীতের ভুবনে নজরুলের সেই রুপ প্রায় অনুপস্থিত। গীতিকার হিসেবে প্রেমিক সত্তারই প্রকাশ ঘটেছে ব্যাপকমাত্রায়। সেখানে কেবল মানব-মানবীর প্রেমই নয়, প্রকাশ ঘটেছে ঈশ্বরপ্রেম, প্রকৃতিপ্রেমেরও। সেইসাথে একদিকে যেমন তিনি লিখেছেন অসংখ্য ইসলামী সংগীত, তেমনি লিখেছেন শ্যামা সংগীত, ভজন, কীর্তন প্রভৃতি।
সংগীতের মতোই কাব্য ভুবনেও ছিল তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি। কবিতার জগতে তিনি এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন প্রেমিকরূপে, আর হাতে রণতূর্য নিয়ে বিদ্রোহ রচনা করেছিলেন সমাজের নানা অন্যায়, পীড়ণ ও অসাম্যের বিরুদ্ধে। তাঁকে শুধুমাত্র বিদ্রোহী কবি অভিধায় অভিহিত করলে তাঁর খণ্ডিত সত্তারই প্রকাশ মেলে। বরং তিনি বিদ্রোহী নন ততখানি যতখানি প্রেমিক। কিংবা তিনি যতখানি বিদ্রোহী ঠিক ততটাই প্রেমিক। তাঁর কাব্যে একদিকে ফুঁটে উঠেছে বিরহি প্রেমিকের আর্তনাদ, প্রেমের জন্য হাহাকার, অন্যদিকে ধ্বনিত হয়েছে অন্যায়, নীপিড়নের বিরুদ্ধে, সব ধরণের জাতি-বর্ণ প্রথা, অসাম্য, বিভেদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। ধনী-গরীব, শাসক- শোষিত, মালিক-শ্রমিক, নারী-পুরুষ, হিন্দু-মুসলিমের চিরকালীন দ্বন্দ্ব, বিভেদ, অসাম্যের বিরুদ্ধেই তাঁর যত বিদ্রোহ। তিনি মানবসৃষ্ট ঈশ্বরকে খোঁজেন নি কখনও বরং মানুষের মাঝেই ঈশ্বরকে খুঁজেছেন, তারই পুজো করেছেন, তাকেই অর্ঘ্য নিবেদন করেছেন প্রতিনিয়ত। ‘অগ্নিবীনা’, ‘ভাঙার গান’, ‘বিষের বাঁশি’, ‘সর্বহারা’, ‘সাম্যবাদী’ প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থের পরতে পরতে ধ্বনিত হয়েছে তাঁর প্রতিবাদী ঝংকার, সাম্যবাদী চেতনার সুর। অন্যদিকে ‘চক্রবাক’, ‘দোঁলন চাঁপা’, ‘নির্ঝর’, ‘সিন্ধু-হিন্দোল’ প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থে প্রকাশ ঘটেছে তাঁর প্রেমিক সত্তার।
বড়দের পাশাপাশি নজরুল ছোটদের জন্যও রেখে গেছেন সাহিত্যের এক সমৃদ্ধ ভান্ডার। ‘ঝিঙে ফুল’ কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি কবিতায় প্রকাশ ঘটেছে শিশুমনের নানা ভাবনা, প্রতিফলন ঘটেছে নানা ইচ্ছের।
কেবল গান কিংবা কবিতা নয় গদ্যসাহিত্যেও ঘটেছে তাঁর স্বচ্ছন্দ পদচারণা। সংখ্যার বিচারে সেগুলির সংখ্যা অল্প হলেও অনুজ্জ্বল নয় মোটেও। তাঁর রচিত উপন্যাস ‘বাঁধন হারা’, ‘মৃত্যুক্ষুধা’, ‘কুহেলিকা’; গল্পগ্রন্থ ‘ব্যাথার দান’, ‘রিক্তের বেদন’, ‘শিউলি মালা’; নাটক ও গীতিনাট্য ‘ঝিলিমিলি’, ‘আলেয়া’, ‘পুতুলের বিয়ে’, ‘মধুমালা’, ‘ঝড়’, ‘পিলে পটকা পুতুলের বিয়ে’ প্রভৃতি হয়ে আছে বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। এছাড়া যুগবানী, দুর্দিনের যাত্রী, রুদ্র মঙ্গল, ধুমকেতু প্রভৃতি প্রবন্ধেও ঘটেছে তাঁর প্রতীভার প্রকাশ। এমনকি বিভিন্ন সময়ে দেয়া তাঁর ভাষণ কিংবা বক্তৃতা, বিভিন্ন চিঠিপত্রগুলিও হয়ে আছে বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ।
প্রকাশমাধ্যম, প্রকাশভঙ্গি যাইই হোক না কেন নজরুলের সমস্ত সৃষ্টিকর্মের উদ্দেশ্য ছিল কেবল মানব মনে সুন্দরের বোধন ঘটানো। সুন্দরের সাধনা নজরুলকে তাড়িত করেছে সব সময়। পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্ত মানবসমাজ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে গড়ে তুলবে মানবিক রাষ্ট্র-এটাই ছিল তাঁর সৃষ্টির একমাত্র ব্রত। সেই সুন্দরের বোধন তিনি কতখানি ঘটাতে পেরেছেন তা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও তাঁর বহুমাত্রিক সৃষ্টি আজও প্রতিটি বাঙালীকে আবিষ্ট করে রেখেছে প্রশ্নাতীতভাবেই।
আরো পড়ুন: কাজী নজরুল ইসলাম : অসাম্প্রদায়িক চেতনায় চিরঞ্জীব
কাজী নজরুল ইসলামের যেকোনো বই কিনতে ভিজিট করুন : https://pbs.com.bd/writer/5919/kazi-nazrul-islam
আপনার পছন্দের যেকোনো বই কিনতে ভিজিট করুন : https://pbs.com.bd/