হুমায়ূন আহমেদ

হুমায়ূনহীন বইমেলার এক দশক

“আমাকে নিয়ে নানা গল্প আছে

সেই গল্পে আছে একটা ফাঁকি

বিরাট একটা বৃত্ত এঁকে নিয়ে

ভেতরে নাকি আমি বসে থাকি।

কেউ জানে না শাওন, তোমাকে বলি

বৃত্ত আমার মজার একটা খেলা

বৃত্ত-কেন্দ্রে কেউ নেই, কেউ নেই

আমি বাস করি বৃত্তের বাইরেই।”

: হুমায়ূন আহমেদ, মেহের আফরোজ শাওনকে লেখা চিরকুট, বলপয়েন্ট।

বৃত্ত বা বৃত্তের বাইরে কোথাও তিনি নেই। স্রেফ নেই। তাঁর না থাকার এই এক দশকে অমর একুশে বইমেলা শুরু হয়েছে। এ আয়োজন-প্রাঙ্গনের প্রতিটি ধূলিকণার হাহাকার তাঁর জন্য। অদেখা ভুবনে থাকা হুমায়ূনের কেমন লাগছে এ ক্ষণ? এ প্রশ্নের উত্তর কোথা পাই?  

বই আর গল্প দুটি ভিন্ন বিষয়। কাগজ, ছাপাখানা আবিষ্কারের বহু আগেও গল্প ছিল। শিকার শেষে, আহার শেষে, আনন্দে একাত্ম হওয়ার মুহূর্ত শেষে। প্রথম আগুন জ্বালাতে শেখার ক্ষণে গল্প ছিল। নিজের বোনা ফসলের মুখ দেখেও মানুষ গল্প বলেছে।

গল্প মানুষ হারায়নি তখনও, যখন সে শোকস্তব্ধ হয়েছে। গলার কাছে অজানা কিছু আটকে থাকা মুহূর্ত মানা যায় না। তখনও আবার গল্পে ফেরা, ধাতস্থ হওয়া। বইয়ের মলাটে বন্দি হওয়ার হাজারও বছর আগে এমন অজস্র গল্প ছিল। সমুদ্র, পর্বত কিংবা ক্ষমতার রক্তচক্ষু সব প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে এ গল্প বিস্তৃত হয়েছে বিশ্বময়। মুখ থেকে মুখে অবিরাম।  

পৃথিবী যখন আদিম সময় পেরিয়ে এসেছে , তখন হুমায়ূনকে মনে হয়, অনেকটা সেই স্বভাবের ধারক। মুখে মুখেই হুমায়ূনকে নিয়ে গল্পের প্রচলন হয়েছে। তাঁর লেখা গল্পের চেয়ে ব্যক্তি হুমায়ূন নিজেই রূপ নিয়েছেন সেরা গল্পে। নন্দিত নরকের লেখক হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার প্রায় ৫০ বছর পরও তুমুলরকম কৌতূহল চলে তাঁকে নিয়ে। মৃত্যুতেও বিনাশ হয় না যার এতটুকু।

গল্প কি পড়া হচ্ছে, নাকি কেউ বলছে পাশে বসে! ঠাহর করার উপায় নেই। বাংলায় আগে ছিল না, এমন গদ্যের জনক তিনি। লেখনী এমন মাত্রায় পৌঁছানো যেকোনো ভাষার সাহিত্যের জন্যই এক বিশেষ ঘটনা। তাঁর বইয়ের মাধ্যমেই পাঠে অভ্যস্থ হয়েছেন সাম্প্রতিক সময়ের পাঠকদের বড় একটি অংশ।  

গল্প বলা ছিল তাঁর নখদর্পণে। সরল-সাবলিল ভাষা, গল্পের এমন বুনন, প্রকাশের পর তা কেন জনপ্রিয় হবে না? পাঠকরাও তাই লুফে নিয়েছেন তাঁকে। সাহিত্যের এই ধারা পাঠকদের জানা ছিল না। একইরকম অজ্ঞাত ছিল বই বাজারসম্পর্কিত ধারণাও। বই যে কাটতিসম্পন্ন একটি পণ্য, বাংলাদেশের প্রকাশনাশিল্পের সাথে জড়িতদেরও বোধকরি তা অজানাই ছিল।

আশির দশকের শুরু থেকে বইমেলায় হুমায়ূন আহমেদের বই বেস্ট সেলার। যে ঘরে কোনো বই নেই, সে ঘরেও প্রবেশ করতে থাকে তাঁর রচনা। যিনি কখনো বই কেনেন নি, তিনিও হুমায়ূন আহমেদের বই কেনার জন্যই আসেন ফেব্রুয়ারির মেলায়। 

অজস্র পাঠকের সারাবছরের প্রতীক্ষা থাকতো তাঁর অটোগ্রাফ-সংবলিত বইয়ের জন্য। মেলায় কর্মরত আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর কর্মতৎপরতার পারদ ওঠানামা করত হুমায়ূনের বইমেলায় আসা, না আসার ওপর। শুধু বাংলাদেশ নয়। একই চিত্র কলকাতা বইমেলাতেও। প্রবাসে যে দেশেই বই বিক্রির স্থানে তিনি হাজির হয়েছেন, সেখানকারই। দেশের প্রকাশনাশিল্প নান্দনিকতা পেয়েছে তাঁকে ঘিরে। 

না থাকার এই ১০ বছরে হুমায়ূন যেন আরও অপ্রতিরোধ্য। প্রকাশনা শিল্প সংশ্লিষ্টরা জানাচ্ছেন, আরও বিক্রি বেড়েছে তার বইয়ের। শুধু তাঁর লেখা নয়, তাঁকে নিয়ে, তাঁর ওপর ভিত্তি করে অসংখ্য বই প্রকাশিত হয়েছে এ পর্যন্ত। বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্য পড়ুয়ারা পিএইচডি করছেন তাঁকে নিয়ে।

না থাকলে পরাণ বেশি পোড়ে। হুমায়ূনহীনতা এ সত্যকেই প্রতিষ্ঠিত করে চলেছে আজকের দিন পর্যন্ত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *