১৮৯৯ সালে ধরায় আগমন কাজী নজরুল ইসলামের। শৈশবেই হারান বাবা, মা’কে। জীবিকা নির্বাহের তাগিদে তিনি বহু কাজ করেছেন। কর্মরত ছিলেন রুটির দোকানে। মসজিদের মুয়াজ্জিন ছিলেন। গান গেয়েছেন লেটো গানের দলে।
নজরুলের ডাক নাম ছিল ‘দুখু মিয়া’। কিন্তু ধুমকেতুর মতো নজরুলের উত্থান যেন সব দুঃখের বিনাশ সাধনে। সমাজের সব ভেদাভেদ গুড়িয়ে দিয়ে সমতার সমাজ প্রতিষ্ঠা ছিল তাঁর গন্তব্য। তৎকালীন সমাজেই নয়, বর্তমানেও সমান প্রাসঙ্গিক তাঁর অসাম্প্রদায়িক সাহিত্য ভাবনা। শুধু বাঙালি কিংবা বাংলা ভাষাভাষী মানুষ নন, গোটা বিশ্বেই সমাদৃত হওয়ার দাবীদার তাঁর মানবতাবাদ।
‘সর্বহারা’ কাব্য গ্রন্থে তিনি এমন এক প্রশ্ন উত্থাপন করেন, যা তাঁর আগে এত সহজে উচ্চারণ করতে পারেননি আর কেউ।
তিনি লিখেন,
“হিন্দু না ওরা মুসলিম?’ ওই জিজ্ঞাসে কোনজন?
কান্ডারী! বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার।”
: কান্ডারী হুঁশিয়ার, সর্বহারা
তাঁর রচিত ‘হিন্দু-মুসলমান’ প্রবন্ধেও বিষয়টি ব্যাখ্যার সূত্রপাত করেছেন। তিনি লিখেছেন, “নদীর পাশ দিয়ে চলতে চলতে যখন দেখি, একটা লোক ডুবে মরছে, মনের চিরন্তন মানুষটি তখন এ-প্রশ্ন করবার অবসর দেয় না যে, লোকটা হিন্দু না মুসলমান। একজন মানুষ ডুবছে, এইটেই হয়ে ওঠে তার কাছে সবচেয়ে বড়, সে ঝাঁপিয়ে পড়ে নদীতে। হিন্দু যদি উদ্ধার করে দেখে লোকটা মুসলমান, বা মুসলমান যদি দেখে লোকটা হিন্দু —তার জন্য তো তার আত্মপ্রসাদ এতটুকু ক্ষুণ্ন হয় না। তার মন বলে, ‘আমি একজন মানুষকে বাঁচিয়েছি —আমারই মতো একজন মানুষকে।”
কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন বাঁধন হারা এক সৃষ্টিশীল। সমাজে মানুষে মানুষে ভেদের মধ্যস্বত্বভোগীদের বিরুদ্ধে তীব্রভাবে জ্বলে উঠেছে তার লেখনী। ‘প্রলয়-শিখা’ কাব্যগ্রন্থের একটি কবিতার কয়েকটি লাইনে স্পষ্ট হয় বিষয়টি।
“কাটায়ে উঠেছি ধর্ম-আফিম-নেশা
ধ্বংস করেছি ধর্ম-যাজকী পেশা
ভাঙি মন্দির, ভাঙি মসজিদ
ভাঙিয়া গির্জা গাহি সঙ্গীত,
এক মানবের একই রক্ত মেশা
কে শুনিবে আর ভজনালয়ের হ্রেষা।”
: বিংশ শতাব্দী, প্রলয়-শিখা
জীবনব্যাপী নজরুল ইসলাম একটি সাম্যের সমাজের স্বপ্নই দেখেছেন। যেখানে কোনো ভেদ তিনি মেনে নিতে পারেননি। ‘সাম্যবাদী’ কাব্য গ্রন্থের একটি কবিতার অংশ উল্লেখ করা যায়—
“গাহি সাম্যের গান-
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান,
যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রীশ্চান।”
: সাম্যবাদী
শুধু ধর্মের ভেদ নয়, কাজী নজরুল ইসলাম সোচ্চার ছিলেন শ্রেণি প্রথা, বর্ণবাদ, গোত্রবাদসহ সমাজে বিরাজমান প্রতিটি বৈষম্যের বিরুদ্ধে। তাঁর কবিতাতেই বিষয়টি স্পষ্ট —
“নাইকো এখানে কালা ও ধলার আলাদা গোরস্থান।
নাইকো এখানে কালা ও ধলার আলাদা গির্জা-ঘর,
নাইকো পাইক-বরকন্দাজ নাই পুলিশের ডর।
এই সে স্বর্গ, এই সে বেহেশ্ত, এখানে বিভেদ নাই,
যত হাতাহাতি হাতে হাত রেখে মিলিয়াছে ভাই ভাই!
নেইকো এখানে ধর্মের ভেদ শাস্ত্রের কোলাহল,
পাদরি-পুরুত-মোল্লা-ভিক্ষু এক গ্লাসে খায় জল।
হেথা স্রষ্টার ভজনা-আলয় এই দেহ এই মন,
হেথা মানুষের বেদনায় তাঁর দুখের সিংহাসন!
সাড়া দেন তিনি এখানে তাঁহারে যে-নামে যে-কেহ ডাকে,
যেমন ডাকিয়া সাড়া পায় শিশু যে-নামে ডাকে সে মাকে!
পায়জামা প্যান্ট ধুতি নিয়া হেথা হয় নাকো ঘুঁষোঘুঁষি,
ধুলায় মলিন দুখের পোশাকে এখানে সকলে খুশি ।”
: সাম্য, সাম্যবাদী
কাজী নজরুল ইসলামের অমিত শক্তির সাহিত্যে তৎকালীন সমাজের ব্যাপক অনিয়ম, অসঙ্গতির মুখোশ উন্মোচিত হয়। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায় —
“জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত-জালিয়াৎ খেলছ জুয়া,
ছুঁলেই তোর জাত যাবে? জাত ছেলের হাতের নয় ত মোয়া।
হুঁকোর জল আর ভাতের হাঁড়ি-ভাব্লি এতেই জাতির জান,
তাই ত বেকুব, করলি তোরা এক জাতিকে এক শ’-খান!
এখন দেখিস্ ভারত জোড়া প’চে আছিস বাসি মড়া,
মানুষ নাই আজ, আছে শুধু জাত-শেয়ালের হুক্কাহুয়া।”
: জাতের নামে বজ্জাতি, বিষের বাঁশি
লেখার জন্য তাঁকে জীবনে চরম মূল্যও দিতে হয়েছে, এমনকি খাঁটতে হয়েছে জেলও। তবে কিছুই তাঁকে পারেনি দমিয়ে রাখতে। যা কিছু তিনি বিশ্বাস করতেন, লালন করতেন সেই সত্য প্রকাশে তিনি ছিলেন সংকোচহীন। সমস্ত নিপীড়ন, নির্যাতন সহ্য করেই তিনি লিখেছেন,
“জানিস নাকি ধর্ম সে যে বর্ম সম সহন-শীল,
তাকে কি ভাই ভাঙতে পারে ছোঁওয়া-ছুঁয়ির ছোট্ট ঢিল।
যে জাত-ধর্ম ঠুন্কো এত,
আজ নয় কাল ভাঙবে সে ত,
যাক্ না সে জাত জাহান্নামে, রইবে মানুষ, নাই পরোয়া।”
: জাতের নামে বজ্জাতি, বিষের বাঁশি
আরও উল্লেখ করা যায় নিচের কবিতার কিছু অংশ।
“সকল জাতই সৃষ্টি যে তাঁর, এ বিশ্ব-মায়ের বিশ্ব-ঘর,
মায়ের ছেলে সবাই সমান, তাঁর কাছে নাই আত্ম পর।
বলতে পারিস, বিশ্ব-পিতা ভগবানের কোন সে জাত?
কোন্ ছেলের তাঁর লাগলে ছোঁয়া অশুচি হন জগন্নাথ?
নারায়ণের জাত যদি নাই, তোদের কেন জাতের বালাই?
(তোরা) ছেলের মুখে থুথু দিয়ে মা’র মুখে দিস ধূপের ধোঁয়া।
ভগবানের ফৌজদারী-কোর্ট নাই সেখানে জাত-বিচার,
পৈতে টিকি টুপি টোপর সব সেথা ভাই একাক্কার।
জাত সে শিকেয় তোলা রবে,
কর্ম নিয়ে বিচার হবে।”
: জাতের নামে বজ্জাতি, বিষের বাঁশি
স্রষ্টা ও ধর্মের নামে পৃথিবীতে বহু কাল ধরে রক্ত ঝরে আসছে। নজরুল নিজেও যেন রক্তাক্ত হয়েছেন এ ভাবনায়। তেমনই একটি কবিতা থেকেই উদ্ধৃতি দেয়া যেতে পারে।
“কে তুমি খুঁজিছ জগদীশ ভাই আকাশ পাতাল জুড়ে’
কে তুমি ফিরিছ বনে-জঙ্গলে, কে তুমি পাহাড়-চূড়ে?
হায় ঋষি দরবেশ,
বুকের মানিকে বুকে ধ’রে তুমি খোঁজ তারে দেশ- দেশ।
সৃষ্টি রয়েছে তোমা পানে চেয়ে তুমি আছ চোখ বুঁজে,
স্রষ্টারে খোঁজো-আপনারে তুমি আপনি ফিরিছ খুঁজে!
ইচ্ছা-অন্ধ! আঁখি খোলো, দেখ দর্পণে নিজ-কায়া,
দেখিবে, তোমারি সব অবয়বে প’ড়েছে তাঁহার ছায়া।”
: ঈশ্বর, সাম্যবাদী
বাংলা সাহিত্যে কাজী নজরুল ইসলাম স্বীয় সৃষ্টি গুণে লাভ করেছেন অমরত্ব। মানবতার প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতাই যেন তাঁকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে এমন সব মহান সাহিত্য। তাঁর লেখনীই এর উদাহরণ :
“হয়ত আমাতে আসিছে কল্কি, তোমাতে মেহেদী ঈসা,
কে জানে কাহার অন্ত ও আদি, কে পায় কাহার দিশা?
কাহারে করিছ ঘৃণা তুমি ভাই, কাহারে মারিছ লাথি?
হয়ত উহারই বুকে ভগবান্ জাগিছেন দিবা-রাতি!”
:মানুষ, সাম্যবাদী
আমৃত্যু নজরুল ছিলেন বাংলা অঞ্চলে হিন্দু-মুসলিম রক্ত ক্ষরণের বিপরীতে মিলনের সুরবাহী। লিখেও গেছেন তাই :
“মোরা এক বৃন্তে দু’টি কুসুম হিন্দু-মুসলমান
মুসলিম তার নয়ন-মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ।
এক সে আকাশ মায়ের কোলে যেন রবি শশী দোলে,
এক রক্ত বুকের তলে, এক সে নাড়ির টান।
এক সে দেশের খাই গো হাওয়া, এক সে দেশের জল,
এক সে মায়ের বক্ষে ফলাই একই ফুল ও ফল।
এক সে দেশের মাটিতে পাই
কেউ গোরে কেউ শ্মাশানে ঠাঁই
এক ভাষাতে মা’কে ডাকি, এক সুরে গাই গান।”
: হিন্দু মুসলমান
আগেই বলা হয়েছে নজরুল আজও প্রাসঙ্গিক। তাঁর সময়ে যে প্রবল বিভক্তির মধ্য দিয়ে বাংলার সমাজ অতিক্রান্ত হয়েছে, আজকের প্রেক্ষিতও এর ভিন্ন নয়। এখনও আছে মানুষে মানুষে ভেদ। নজরুল চিরঞ্জীব তাই সব কালেই।
কাজী নজরুল ইসলামের যেকোনো বই কিনতে ভিজিট করুন : https://pbs.com.bd/writer/5919/kazi-nazrul-islam
আপনার পছন্দের যেকোনো বই কিনতে ভিজিট করুন : https://pbs.com.bd/